লক্ষ্মীপুর জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে রয়েছে মেঘনা নদী, দালাল বাজার জমিদার বাড়ী, কামানখোলা জমিদার বাড়ী, নারিকেল ও সুপারির বাগান, তিতা খাঁ জামে মসজিদ, জ্বীনের মসজিদ, খোয়া সাগর দিঘী ইত্যাদি।

লক্ষ্মীপুর জেলা রাজধানী ঢাকা থেকে একশো ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে। লক্ষ্মীপুর জেলায় একসময় লবণ চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। রহমত খালি নদীর তীরে অবস্থিত লক্ষীপুর জেলায় রয়েছে বিভিন্ন সময় জেগে ওঠা চর এলাকা, ইলিশ, নারিকেল ও সুপারি বাগানের খ্যাতি। এই ব্লগে আমরা জানব লক্ষীপুরের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দর্শনীয় কিছু স্থান সম্পর্কে।

আরও পড়তে পারেন: লক্ষ্মীপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত

প্রত্যেকটি জেলা নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য ও স্থানের জন্য বিখ্যাত হয়ে থাকে। লক্ষ্মীপুর জেলা ও এর ব্যতিক্রম নয়। লক্ষ্মীপুর জেলার বিশেষ দর্শনীয় স্থানসমূহের নিচে উল্লেখ করা হলো-

১. দালাল বাজার জমিদার বাড়ি

লক্ষ্মীপুর জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে দালালবাজার জমিদার বাড়ি। কাপড়ের ব্যবসায়ী লক্ষ্মী নারায়ণ বৈষ্ণব প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে কলকাতা থেকে ব্যবসা করতে দালাল বাজার আসেন এবং এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। ১৯৪৬ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জমিদারগণ বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলে তাদের জমিদার বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে রয়ে যায়।

দালাল বাজার জমিদার বাড়ি
লক্ষ্মীপুর জেলার দর্শনীয় স্থান- দালাল বাজার জমিদার বাড়ি

প্রায় ৫ একরের জমিদার বাড়িটির রাজকের রাজপ্রাসাদ ও অতিথি শালা, অন্দরমহল ,বাড়ির প্রাচীর ,সান বাঁধানো ঘাট, বাড়ির পিছনে নাট মন্দির, পূজা মণ্ডপ, বিরাট আকারে লোহার সিন্ধুক, কয়েক টন ওজনের অনেকগুলো লোহার বিম এখনো দৃশ্যমান। যা দেখতে দূর দূরান্ত থেকে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটে আসেন।

প্রশাসনিক উদ্যোগে এখন পরিত্যক্ত এই বাইরের সংস্কার কাজ চলছে। লক্ষ্মীপুর সদর থেকে বাস বা সিএনজি নিয়ে দালাল বাজার এলেই এই রাজবাড়িটি দেখতে পাবেন।অনেকে মনে করেন জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণের নাম থেকেই লক্ষ্মীপুর জেলার নামকরণ।

২. কামানখোলা জমিদার বাড়ি

কামানখোলা জমিদার বাড়ি লক্ষীপুরের আরও একটি দর্শনীয় স্থান। এটি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজার ইউনিয়নের দালাল বাজার থেকে প্রায় ২/৩ কি: মি: দূরে অবস্থিত। এটি প্রাচীন ও বিখ্যাত একটি জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত।

কামানখোলা জমিদার বাড়ি
লক্ষ্মীপুর জেলার দর্শনীয় স্থান- কামানখোলা জমিদার বাড়ি

দালাল বাজারের কাছে নারিকেল ও সুপারি বাগানে ঘেরা এই কামান খোলা জমিদার বাড়ি নির্মাণ করেন জমিদার রাজেন্দ্রনাথ দাস। শত্রু মুক্ত রাখতে জমিদার বাড়িটির ৩ দিকে ছিল প্রায় ১০০ ফুট চওড়া খাল এবং সামনের দিকে স্থলপথে সংযোগ।

কিভাবে যাবেন

লক্ষ্মীপুর বাস স্ট্যান্ড ও রায়পুর বাসস্ট্যান্ড থেকে সিএনজি বা অটো রিক্সা করে যাওয়া যায় এই জমিদার বাড়ি।

৩. ‘মসজিদ-ই-জামে আবদুল্লাহ’ বা জিনের মসজিদ

সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন রায়পুর পৌর শহর থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার পূর্বে পীর ফয়েজ উল্লাহ সড়কের দক্ষিণ দিকে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠা জিনের মসজিদ। যা পুরনো স্থাপত্যের আরেক নিদর্শন। এক রাতে জিনরা এ মসজিদ তৈরি করে। এমন অনেক রূপকথা জড়িয়ে আছে এই মসজিদকে ঘিরে। যদিও স্থানীয়রা এসব কথা মানতে নারাজ।

জিনের মসজিদ
লক্ষ্মীপুর জেলার দর্শনীয় স্থান- জিনের মসজিদ

মসজিদের বর্তমান ইমাম সাহেবের পূর্ব পুরুষরাই এটি নির্মাণ করেন।

১৮৮৮ সালে ৫৭ শতাংশ জমির উপর নির্মিত এই মসজিদের দৈর্ঘ্য ১১০ ফুট এবং প্রস্থ ৭০ ফুট। দিল্লীর শাহী জামে মসজিদের নকশায় আদলে নির্মিত এই মসজিদের ছাদে বড় আকারের ৩ টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের  তলদেশে প্রায় ২৫ ফুট গভীরে একটি গোপন ইবাদতখানা রয়েছে।

এই মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুল্লাহ এই গোপন ইবাদতখানায় ধ্যান মগ্ন থাকতেন। বর্তমানে এই ইবাদত খানাটি পানি পূর্ণ কূপে পরিণত হয়েছে। প্রায় ১৫ ফুট ভিত্তির উপর ইটের তৈরি এই মসজিদের মিনার, গম্বুজ ও মূল ভবনের নকশার নান্দনিকতা সকলকে আকর্ষণ করে।

মসজিদের সামনে ও পাশে দুইটি পুকুর রয়েছে। প্রচলিত আছে, রাতের আধারে জ্বীন কতৃক এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে এবং জ্বিনেরা এখানে বেশকিছু বছর পর্যন্ত ইবাদত করেছিল। গভীর রাতে স্থানীয় বাসিন্দারা জ্বীনদের জিকিরের আওয়াজ শুনতে পেত। প্রচলিত কাহিনীর জন্য প্রায় ১৩০ বছরের পুরনো ‘মসজিদ-ই-জামে আবদুল্লাহ’ বর্তমানে জ্বীনের মসজিদ হিসেবে বেশি পরিচিত।

৪. রায়পুর বড় মসজিদ

দুইশো বছরেরও অধিক পুরনো ২৩ গম্বুজ বিশিষ্ট অপূর্ব এই মসজিদটি স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠাতা মরহুম পীরে কামেল শাহ ফজলুল্লাহ ওরফে বুড়া হযরত রাদিয়াল্লাহু বাংলা ১২১৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। লোকমুখে শোনা যায় টানা ১০ বছর মসজিদটি নির্মাণ কাজ চলেছিল।সময় করে দেখে নিতে পারেন লক্ষীপুরের রায়পুরের এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি।

রায়পুর বড় মসজিদ
রায়পুর বড় মসজিদ

৫. খোয়াসাগর দীঘি

আনুমানিক ১৭৫৫ সালে জমিদার ব্রজ বল্লভ রায় মানুষের পানীয় জল সংরক্ষণে এ দীঘিটি খনন করেন ২৫ একর এলাকা জুড়ে দালাল বাজার সংলগ্ন এই খোয়া সাগর দিঘী। ধারণা করা হয় এটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো।

খোয়াসাগর দীঘি
খোয়াসাগর দীঘি

এখানে কুয়াশাকে স্থানীয় ভাষায় ‘খোয়া’ বলা হয়। অন্যদিকে দিঘীর বিরাট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের ফলে এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অন্য প্রান্ত কুয়াশাময় মনে হত তাই এই দিঘীর নাম খোয়া সাগর দিঘী।

শোভাবর্ধনের জন্য দীঘির পাড়ে অসংখ্য গাছ  লাগানো হয়েছে । দীঘির স্বচ্ছ পানি ও মনোরম পরিবেশের জন্য প্রতিদিন অনেক বিনোদন প্রেমীরা এই দীঘির পাড়ে বেড়াতে আসেন। এ দিঘী নিয়ে বহু উপ কথা ছড়িয়ে আছে।

কিভাবে খোয়াসাগর দীঘি যাবেন

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর তেমুহনী থেকে যে কোন গাড়ি সিএনজি ইত্যাদি দিয়ে দালাল বাজার যাওয়ার পথেই খোয়া সাগর দীঘি দেখতে পাওয়া যায়।

রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বাসে করে লক্ষ্মীপুর জেলায় যাওয়া যায়। বাস টার্মিনাল থেকে রিকশা বা সিএনজি নিয়ে গেলে প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলে সুন্দর খোয়া সাগর দিঘির দেখা পাবেন। তাছাড়া যদি লঞ্চে করে যেতে চান তাহলে ঢাকা সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরী ঘাটে পৌঁছে যাবেন।

৬. সাইফিয়া দরবার শরীফ

মজু চৌধুরীর হাট যাওয়া বা আসার সময় রাস্তার পাশেই দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন এই সাইফিয়া দরবার শরীফ। এখানে রয়েছে ছাত্র ছাত্রীদের জন্য একটি মাদ্রাসা।  এই দরবার শরীফ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান করে থাকে। পুরো লক্ষ্মীপুর এলাকা জুড়ে তাদের অনেক ভক্ত রয়েছে।

সাইফিয়া দরবার শরীফ

৭. মজু চৌধুরীর হাট

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরত্বে চর রমণী মোহন ইউনিয়নে এই ঐতিহাসিক মজু চৌধুরীর হাট। এখানে পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তৈরি একটি সুইচ গেট রয়েছে। যার গোড়াতে পতন লক্ষ্মীপুর ভোলা ফেরিঘাট। খুব সহজে এখান থেকে ভোলা যাওয়া যায়। এই ঘাটে দিনে কয়েকবার নদীর মাছ আসে ও ব্যাপারিরা কিনে নিয়ে যায় শহরের দিকে।

৮. তিতাখা মসজিদ

প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মীপুর শহরের উপর তিতাখা মসজিদটি শৈল্পিক কারুকার্য ও দৃষ্টিনন্দনতার জন্য সকল সময়ে খ্যাতি লাভ করেছে। ঐ সময় হযরত আজিম শাহ বাগানের মধ্যে এই মসজিদটি আবিষ্কার করেন। বর্তমান সরকার সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ায় মসজিদটি সংরক্ষিত স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

৯. আলেকজান্ডার বেড়িবাঁধ 

মেঘনা নদীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেতে চার কিলোমিটার পাথরের তৈরি বাঁধটির নাম আলেকজান্ডার বেড়িবাঁধ। প্রমত্তা মেঘনা ঢেউ বিকেলের সুনিশ্চিত বাতাস আর রক্তিম সূর্যাস্ত সব মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর এক পরিবেশ দেখতে যেতে হবে আলেকজান্ডার বেড়িবাঁধ।

লক্ষ্মীপুর সদর থেকে সরাসরি বাস অথবা সিএনজি চালিত অটোরিকশা করে ৬০ বা ৭০ টাকায় যেতে পারেন আলেকজান্ডার বেড়িবাঁধ। এটি জেলা শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দক্ষিণে রামগতি উপজেলার মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত। নোয়াখালী জেলার সোনাপুর থেকে ও সড়ক পথে এখানে আসা যায়।

সারাদিন কান্তি দূর করতে বিকেল হলেই পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসেন অনেকেই ।নদীতে যখন ভাটা পড়ে পুরো জায়গাটা বিস্তৃত আকার ধারণ করে তখন সেখানে হাঁটতে অনেক ভালো লাগে। এই স্থানটিকে অনেকেই মেঘনা বিচ বা মিনি কক্সবাজার বলে থাকে।

বেড়িবাঁধ থেকে স্পিডবোটে করে ঘুরে আসতে পারেন নদীর বুকে জেগে ওঠা কয়েকটা চর থেকে। টুনা চর, তেলিয়ার চর ও চর গজারিয়া একটু দূরেই প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় লাগে।

তবে চর আব্দুল্লাহ কাছে বলে অনেকেই সেখানে ঘুরতে ও পিকনিক করতে যান। এই চর এলাকা গুলোতে রয়েছে কয়েকটি মহিষের বাথান। হাজার হাজার ভেড়া ও মহিষ দিনরাত ঘুরে বেড়ায় এখানে মন ভোলানো বাতাস আর নানা ধরনের পাখি দেখতে পাবেন।

পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন স্পিডবোটে। আসা যাওয়ার খরচ ১২০ টাকা ।রিজার্ভ নিলে পনেরশো টাকার মত লাগে।

আলেকজান্ডার বাঁধ থেকে কিভাবে বাড়ি ফিরবেন

যারা লক্ষ্মীপুর যাবেন তারা এখান থেকে সিএনজি নিয়ে যেতে পারেন। আর যারা ঢাকা বা চট্টগ্রাম যাবেন তারা সিএনজি নিয়ে চলে আসতে পারেন লক্ষ্মীপুর বাস স্ট্যান্ড অথবা নোয়াখালী সোনাপুর বাস স্ট্যান্ড এখান থেকে সারা দেশের সব ধরনের গাড়ি পাবেন।

আশা করি ,এ আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে লক্ষ্মীপুর জেলার বিশেষ দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে সার্বিক ধারণা পেয়েছেন ।তাই ছুটির সময় এই দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে আসতে পারবেন অতি সহজে।