নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণ গাইড: কিভাবে যাবেন, দর্শনীয় স্থান, ভ্রমণ খরচ ও টিপস
নিঝুম দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের কোলে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যে ভরপুর যেন সাগরের মাঝে এক টুকরো স্বর্গ। দেখুন নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের সম্পূর্ণ ট্রাভেল গাইড।
নিঝুম দ্বীপ (Nijhum Dwip) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে বঙ্গোপসাগরের মাঝে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত। দ্বীপটি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত।
বঙ্গোপসাগরের কোলে এই দ্বীপটি নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যে ভরপুর যেন সাগরের মাঝে এক টুকরো স্বর্গ। দ্বীপের একদিকে সাগরের উত্তাল ঢেউ আর অন্যদিকে সুবিশাল সবুজ মাঠ আর সারি সারি গাছের ঘন বন।
নিঝুম দ্বীপের নির্জন পরিবেশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এবং এখানকার বন্য প্রাণীরাই পর্যটকদের কাছে মূল আকর্ষণ। দ্বীপের সৈকতে এসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ আর নির্জনতা যে কোনো ব্যক্তির মনের অস্থিরতাকে শান্ত করতে পারে। তাই ঘুরে আসতে পারেন দ্বীপটি।
নিঝুম দ্বীপ সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন: নিঝুম দ্বীপ কোথায় অবস্থিত
এই ব্লগে শেয়ার করলাম নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণ গাইড, যেখানে নিঝুম দ্বীপের দর্শনীয় স্থানগুলো কি কি, নিঝুম দ্বীপ কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন ও খরচ কত হবে বিস্তারিত জানাব।
Table of Contents
নিঝুম দ্বীপের দর্শনীয় স্থানসমূহ
নিঝুম দ্বীপের আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থানগুলো হচ্ছে সুমুদ্র সৈকত, দীর্ঘ কাঠের সেতু, প্রবাল প্রাচীর এখানকার বন্য প্রাণী, ও প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। নিঝুম দ্বীপের অন্যতম দর্শনীয় হচ্ছে চিত্রা হরিণ ও শীতকালের অতিথি পাখি। একসঙ্গে এতো চিত্রা হরিণ দেশের আর কোথাও দেখা যায় না।
১. সমুদ্র সৈকত
নিঝুম দ্বীপের সমুদ্র সৈকতগুলি অত্যন্ত মনোরম। এখানে সাদা বালি দিয়ে তৈরি বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত রয়েছে।
২. কাঠের সেতু
ওপরে নীল আকাশ। নিচে স্বচ্ছ জলরাশি। এর মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে ৮০০ মিটারের কাঠের এক সেতু। সেতু দিয়ে এগিয়ে গেলেই মেঘনার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য।
এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য মন কাড়ছে পর্যটকদের। কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সেতুটি। পর্যটকরা এর নাম দিয়েছেন নামার বাজার সমুদ্র সৈকত সেতু। সেতুর মাঝখানে মাঝখানে রয়েছে ছাউনি।
পর্যটকরা ছাউনিতে বসে বিশ্রাম নেন। শেষ বিকেলের আলোয় ছাউনিতে বসে সূর্য ডোবার দৃশ্যও উপভোগ করেন অনেকে।
৩. প্রবাল প্রাচীর
নিঝুম দ্বীপের প্রবাল প্রাচীরগুলি বিভিন্ন রঙের এবং এখানে বিভিন্ন ধরনের মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী দেখা যায়।
৪. চিত্রা হরিণ
নিঝুম দ্বীপ চিত্রা হরিণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। এখানে প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি চিত্রা হরিণ রয়েছে।
৫. প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির
নিঝুম দ্বীপের উত্তর-পূর্ব অংশে একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটি ১৫০০ বছরের পুরানো বলে মনে করা হয়।
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণ গাইড: ভ্রমণের সেরা সময়
নিঝুম দ্বীপের সৌন্দর্য্যে আপাদমস্তক অবগাহন করার জন্য শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে শীত ও বসন্তকাল। হেমন্তের শেষলগ্নে তথা অক্টোবর থেকে এপ্রিলের ঠিক মাঝামাঝি সময়টাই উপযুক্ত সময়। এ সময় রাস্তাঘাট শুকনো থাকায় আশেপাশের যে কোনো জায়গায় যাওয়া যাবে। এছাড়া হরিণ দেখার জন্য বনের পথে হাটতে সুবিধা হবে।
বর্ষাকালে গেলে হাটু সমান কাদায় পুরো দ্বীপ হেটে ঘুরতে হবে। যানবাহন নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হবে। তবে ভোসন রসিকদের জন্য সুখবর হল যে এ সময়টাতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় সেখানে। এছাড়া বছরের বাকিটা সময় মেঘনা নদী ও সাগর অনেক উত্তাল থাকে।
নিঝুম দ্বীপ কিভাবে যাবেন
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে যেতে হলে প্রথমে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায় যেতে হবে। হাতিয়া উপজেলায় পৌঁছানোর পর, মোটর সাইকেল বা ট্রলার নিয়ে নিঝুম দ্বীপ যেতে হবে।
বাসে যাওয়ার উপায়
ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপে বাসে যাওয়ার জন্য প্রথমে আপনাকে নোয়াখালী সোনাপুর বাস টার্মিনালে যেতে হবে। ঢাকার সায়দাবাদ, কমলাপুর ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। এসব বাসে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৩৫০-৪৫০ টাকা।
নোয়াখালী সোনাপুর বাস টার্মিনালে পৌঁছানোর পর আপনাকে সিএনজি অটোরিকশায় চেয়ারম্যান ঘাট যেতে হবে। চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ট্রলারে করে নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে যেতে হবে। বন্দরটিলা ঘাট থেকে নামার বাজারের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার।
- সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে- এশিয়া লাইন, এশিয়া ক্লাসিক, একুশে এক্সপ্রেস ও হিমাচল এক্সপ্রেসের বাস নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে ছাড়ে। বাসের ভাড়া: ৩৫০-৪৫০ টাকা
- কমলাপুর বাস টার্মিনাল থেকে : এশিয়া লাইন, এশিয়া ক্লাসিক, একুশে এক্সপ্রেস ও হিমাচল এক্সপ্রেসের বাস নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে ছাড়ে। বাসের ভাড়া: ৩৫০-৪৫০ টাকা
- মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে : এশিয়া লাইন, এশিয়া ক্লাসিক, একুশে এক্সপ্রেস ও হিমাচল এক্সপ্রেসের বাস নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে ছাড়ে। বাসের ভাড়া: ৩৫০-৪৫০ টাকা
নোয়াখালী সোনাপুর বাস টার্মিনাল থেকে বন্দরটিলা ঘাটে যাওয়ার জন্য: সিএনজি অটোরিকশায় জনপ্রতি ভাড়া: ১০০ টাকা। বন্দরটিলা ঘাট থেকে নামার বাজারে যাওয়ার জন্য ট্রলারে জনপ্রতি ভাড়া: ১৫০ টাকা।
ট্রেনে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার উপায়
ট্রেনে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার জন্য ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে উপকুল এক্সপ্রেস, নোয়াখালী এক্সপ্রেস, বা সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে নোয়াখালীর মাইজদি স্টেশনে নামুন। এরপর, মাইজদি থেকে সিএনজি বা লোকাল বাসে চেয়ারম্যান ঘাট যান। এরপর চেয়ারম্যান ঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে যেতে ট্রলার নিন।
ঢাকা থেকে ট্রেনের টিকেটের শ্রেণি ভেদে ভাড়া ২৩০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। মাইজদি থেকে চেয়ারম্যান ঘাট যেতে সিএনজি রিজার্ভ ভাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং লোকাল বাসের ভাড়া জনপ্রতি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। চেয়ারম্যান ঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে যেতে ট্রলার ভাড়া জনপ্রতি ২২ টাকা।
ট্রেনে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার টিপস:
- ট্রেনের টিকিট আগে থেকেই কেটে নিন।
- ট্রেনের সময়সূচি আগে থেকেই জেনে নিন।
- চেয়ারম্যান ঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে যেতে ট্রলারের সময়সূচি আগে থেকেই জেনে নিন।
লঞ্চে যাওয়ার উপায়
ঢাকার সদরঘাট থেকে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে লঞ্চে যাত্রা করুন। লঞ্চটি সন্ধ্যা ৫:৩০ মিনিটে ছাড়ে এবং পরদিন সকাল ৮:০০ থেকে ৯:০০ মিনিটের মধ্যে হাতিয়ার তমুরুদ্দী ঘাটে পৌঁছায়।
হাতিয়ার তমুরুদ্দী ঘাট থেকে মোটর সাইকেল বা ট্রলারে করে মোক্তারিয়া ঘাটে যান। মোটর সাইকেলের ভাড়া ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা এবং ট্রলারের ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা।
মোক্তারিয়া ঘাট থেকে ট্রলারে করে নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে যান। ট্রলারের ভাড়া জনপ্রতি ২২ টাকা।
লঞ্চের টিকেটের ভাড়া শ্রেণি ভেদে ১,০০০ থেকে ২,৫০০ টাকা পর্যন্ত। লঞ্চে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সময় প্রায় ১৬ ঘন্টা।
চট্টগ্রাম থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার উপায়
চট্টগ্রাম থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার জন্য এ কে খান মোড় থেকে সোনাপুরের বাস নিন। বাসের ভাড়া জনপ্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। তারপর সোনাপুর বাস টার্মিনালে থেকে সিএনজি অটোরিকশায় চেয়ারম্যান ঘাট যেতে হবে। সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা। চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ট্রলারে করে নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে যান। ট্রলারের ভাড়া জনপ্রতি ২২ টাকা।
নিঝুম দ্বীপ কোথায় থাকবেন
নিঝুম দ্বীপে পর্যটকদের জন্য রয়েছে অবকাশযাপন কেন্দ্র, যেখানে রয়েছে পানি সরবরাহ এবং জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। নিঝুম দ্বীপে থাকার জন্য হোটেল, মোটেল এবং ক্যাম্পিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। হোটেল এবং মোটেলগুলি দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত।
হোটেলগুলির ভাড়া মোটেলগুলির চেয়ে বেশি। ক্যাম্পিং এর ব্যবস্থা নিঝুম দ্বীপের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত চৌধুরী খাল এলাকায় রয়েছে।
নিঝুম দ্বীপের হোটেল ও মোটেল:
- নিঝুম রিসোর্ট (অবকাশ হোটেল), নামার বাজার
- হোটেল শাহিন, নামার বাজার
- হোটেল সোহেল, নামার বাজার
- মসজিদ বোর্ডিং, নামার বাজা
- নিঝুম ড্রিম ল্যান্ড রিসোর্ট, বন্দরটিলা
- হোটেল দ্বীপ সম্পদ, (সৈয়দ চাচার থাকা ও খাওয়ার হোটেল) নামার বাজার
- হোটেল শেরাটন, বন্দরটিলা বাজার
- জেলা পরিষদ ডাকবাংলো
- বন বিভাগের ডাকবাংলো
- মাহমুদ বোডিং
- প্রাথমিক বিদ্যালয়
- হোটেল আমেনা ইন্টারন্যাশনাল
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের জন্য হোটেল বা মোটেল বেছে নেওয়ার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিবেচনা করা যেতে পারে:
- বাজেট : হোটেল এবং মোটেলের ভাড়া ভিন্ন ভিন্ন। তাই আপনার বাজেট অনুযায়ী হোটেল বা মোটেল বেছে নিতে হবে।
- সুযোগ-সুবিধা : হোটেল এবং মোটেলগুলির বিভিন্ন রকমের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। আপনার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী হোটেল বা মোটেল বেছে নিতে হবে।
- অবস্থান : হোটেল এবং মোটেলগুলি দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত। আপনি যে দর্শনীয় স্থানগুলি দেখতে চান তার কাছাকাছি হোটেল বা মোটেল বেছে নিতে পারেন।
- নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের জন্য ক্যাম্পিং একটি চমৎকার বিকল্প। ক্যাম্পিং এর মাধ্যমে আপনি প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পারবেন।
নিঝুম দ্বীপ খাবারের ব্যবস্থা
খাবারের জন্য স্থানীয় হোটেল রয়েছে যাতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চাল, মাছ, মুরগী, ডিম ইত্যাদি খাবার পাওয়া যায়। এছাড়াও, স্থানীয়দের কাছ থেকে খাবার কেনার সুযোগ রয়েছে।
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের টিপস
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে গেলে আপনাকে কিছু সতর্কতা মেনে চলতে হবে। এগুলো হলো:
- জলবায়ু : নিঝুম দ্বীপের জলবায়ু গরম এবং আর্দ্র। তাই হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরতে হবে।
- মশা : নিঝুম দ্বীপে মশার উপদ্রব রয়েছে। তাই মশা প্রতিরোধক ব্যবহার করতে হবে।
- খাদ্য : নিঝুম দ্বীপে খাবারের দাম বেশি হতে পারে। তাই খাবার কেনার আগে দাম জেনে নিতে হবে।
- নিরাপত্তা : নিঝুম দ্বীপ একটি প্রত্যন্ত এলাকা। তাই ভ্রমণের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- নিঝুম দ্বীপ একটি অনন্য ও মনোরম স্থান। এখানে প্রকৃতির সাথে একাত্মতা অনুভব করা যায়। তাই নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণ একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হতে পারে।