সন্দ্বীপ কিসের জন্য বিখ্যাত – দর্শনীয় স্থান ও বিখ্যাত খাবার
সন্দ্বীপ মূলত এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। জানুন সন্দ্বীপ কেন বিখ্যাত, সন্দ্বীপের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান ও বিখ্যাত খাবার-দাবার সম্পর্কে কিছু তথ্য।
সন্দ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত উপজেলা। এটি বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রাচীন একটি দ্বীপ।
বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে অতি প্রাচীন এই দ্বীপটি। সন্দ্বীপ এককালে কম খরচে মজবুত ও সুন্দর জাহাজ নির্মাণের জন্য পৃথিবীখ্যাত ছিল।
ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় এই জাহাজ রপ্তানি করা হত। তুরস্কের সুলতান এই এলাকার জাহাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এখান থেকে বেশ কিছু জাহাজ কিনে নেন।
ভারতবর্ষের মধ্যে সন্দ্বীপ ছিল একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর। লবণ ও জাহাজ ব্যবসা, শস্য সম্পদ ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগিজরা সন্দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেন।
উপমহাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণকারীরা এই অঞ্চলে এসে তাদের জাহাজ নোঙ্গর করতেন এবং সহজ বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং পরিবহন সুবিধাদি থাকায় এই অঞ্চলে ব্যবসা এবং বসতি স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করতেন।
১৭৭৬ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি বছর সন্দ্বীপে উৎপাদিত প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার মণ লবণ, তিনশ জাহাজে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হত।
আরও পড়ুন:
সন্দ্বীপ কিসের জন্য বিখ্যাত
সন্দ্বীপ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এটি একটি দ্বীপপুঞ্জ যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। সন্দ্বীপের বিস্তৃত সৈকত, সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
সন্দ্বীপ বিখ্যাত হওয়ার কারণগুলো হলো:
- প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: সন্দ্বীপে রয়েছে সুন্দর সমুদ্র সৈকত, সবুজ বন, এবং ম্যানগ্রোভ বনসহ বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণ
- ঐতিহাসিক গুরুত্ব: সন্দ্বীপ একটি ঐতিহাসিক দ্বীপ যেখানে বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপত্য এবং নিদর্শন রয়েছে।
- সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য: সন্দ্বীপের মানুষের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা। এখানে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, এবং ভাষার মানুষ বাস করে।
সন্দ্বীপের পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল ও চ্যানেলের পূর্ব পাড়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা ও মীরসরাই উপজেলা। উত্তরে বামনী নদী। পশ্চিমে মেঘনা নদী, নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর ও হাতিয়া উপজেলা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে সন্দ্বীপের আয়তন প্রায় ৬৩০ বর্গমাইলের হলেও মেঘনার রাক্ষুসি ঢেউয়ের ছোবলে ক্রমাগত নদী ভাঙনের কারণে বর্তমানে এটি মাত্র ৮০ বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পরিণত হয়েছে।
সন্দ্বীপের দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল (৪০ কিলোমিটার) ও প্রস্থ ৩-৯ মাইল (৫-১৫ কিলোমিটার)। সন্দ্বীপ ১৯৫৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত সন্দ্বীপ নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও পরবর্তিতে একে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালে সন্দ্বীপ থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়।
সন্দ্বীপে একটি পৌরসভা রয়েছে, যা ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। এ উপজেলায় বর্তমানে ১টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন রয়েছে। সম্পূর্ণ সন্দ্বীপ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম সন্দ্বীপ থানার আওতাধীন।
২০২৩ সালের হিসাবে, সন্দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ২৫০,০০০। ২০২২ সালের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ২.৫%। সন্দ্বীপের জনসংখ্যার বেশিরভাগই মুসলমান। এখানে কিছু হিন্দু, বৌদ্ধ, এবং খ্রিস্টানও বাস করে। সন্দ্বীপের জনসংখ্যা প্রধানত কৃষিজীবী। এখানে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, এবং ফলমূল। সন্দ্বীপের কিছু মানুষ মৎস্য চাষও করে।
সন্দ্বীপের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানসমূহ
সন্দ্বীপের কিছু বিখ্যাত পর্যটন আকর্ষণ বা দর্শনীয় স্থান হলো-
- সন্দ্বীপ জাতীয় উদ্যান: এই উদ্যানটি বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাসস্থল। এখানে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন, বনের ভেতরের জলাভূমি, এবং সমুদ্র সৈকত।
- সন্দ্বীপের সমুদ্র সৈকত: সন্দ্বীপের সমুদ্র সৈকতগুলি সুন্দর এবং পরিষ্কার। এখানে সাঁতার কাটা, সূর্যস্নান, এবং নৌকা ভ্রমণের মতো বিভিন্ন কার্যকলাপ করা যায়।
- সন্দ্বীপের ঐতিহাসিক স্থাপত্য: সন্দ্বীপের বিভিন্ন গ্রামে রয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপত্য এবং নিদর্শন। এর মধ্যে রয়েছে মসজিদ, মন্দির, এবং স্থাপত্যের অবশেষ।
- সন্দ্বীপের মসজিদ: এই মসজিদটি ১৫শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন।
- সন্দ্বীপের শুকনা দিঘী: এই দিঘিটি ১৬শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। এটি একটি বিশাল দিঘি যা সন্দীপের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে।
- সন্দ্বীপের আমানুলার চর: এই চরটি একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এখানে রয়েছে সুন্দর সমুদ্র সৈকত, ম্যানগ্রোভ বন, এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণী।
সন্দীপ একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতির দ্বীপ। এখানে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
সন্দ্বীপের বিখ্যাত খাবার
সন্দ্বীপের বিখ্যাত খাবারের মধ্যে রয়েছে এখানকার ইলিশ, চিংড়ি, কোরাল, লইট্যা মাছ সহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ। এছাড়া দ্বীপের বিখ্যাত বিনয় সাহার মিষ্টির খ্যাতি দেশ-বিদেশ সর্বত্র।
ইলিশ সাধারণত ভর্তা, পোলাও, এবং মাছ ভাজা করে খাওয়া হয়। চিংড়ি সাধারণত ভাজা, ঝোল, এবং মাছ কাবাব করে খাওয়া হয়।
সন্দ্বীপের মিষ্টিগুলিও তার সুস্বাদু স্বাদের জন্য বিখ্যাত। সন্দ্বীপের বিখ্যাত মিষ্টিগুলির মধ্যে রয়েছে সন্দেশ, পায়েস, এবং হালুয়া।
সন্দ্বীপ নামকরণের ইতিহাস
সন্দ্বীপের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন মতামত শোনা যায়। কারও কারও মতে বার আউলিয়ারা চট্টগ্রাম যাত্রার সময় এই দ্বীপটি জনমানুষহীন অবস্থায় আবিষ্কার করেন এবং নামকরণ করেন `শুণ্যদ্বীপ`, যা পরবর্তীতে `সন্দ্বীপে` রুপ নেয়। ইতিহাসবেত্তা বেভারিজের মতে চন্দ্র দেবতা `সোম` এর নামানুসারে এই এলাকার নাম `সোম দ্বীপ` হয়েছিল যা পরবর্তীতে `সন্দ্বীপে` রুপ নেয়।
কেউ কেউ দ্বীপের উর্বরতা ও প্রাচুর্যের কারণে দ্বীপটিকে `স্বর্ণদ্বীপ` আখ্যা প্রদান করেন। উক্ত `স্বর্ণদ্বীপ` হতে `সন্দ্বীপ` নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়। দ্বীপের নামকরণের আরেকটি মত হচ্ছে পাশ্চাত্য ইউরোপীয় জাতিগণ বাংলাদেশে আগমনের সময় দূর থেকে দেখে এই দ্বীপকে বালির স্তুপ বা তাদের ভাষায় `স্যান্ড-হীপ` (Sand-Heap) নামে অভিহিত করেন এবং তা থেকে বর্তমান `সন্দ্বীপ` নামের উৎপত্তি হয়।
এছাড়া ভ্রমণ ও ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ফরাসি ও ওলোন্দাজ পরিব্রাজকরা প্রায়ই সন্দ্বীপে আগমন করতেন। এই দ্বীপের রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পর্যটক এসেছেন এখানে।
১৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সন্দ্বীপে আসেন। ১৫৬৫ সালে ডেনিশ পর্যটক সিজার ফ্রেডরিক সন্দ্বীপে আসেন এবং এর বহু প্রাচীন নিদর্শনের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারী মোজাফ্ফর আহমেদের সাথে সন্দ্বীপে আসেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সন্দ্বীপ ভ্রমণের সময়কার স্মৃতির পটভূমিকাতেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর মধুবালা গীতিনাট্য রচনা করেন। সন্দ্বীপে বৃক্ষের ছায়াতলে বসে নজরুল তাঁর চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা রচনা করেন।
দেশ-বিদেশে ভ্রমন সংক্রান্ত নিত্য নতুন তথ্য ও টিপস পেতে ভিজিট করুন GhuraGhuri.com